• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন

“আমরা বীরের জাতি”

Md. Nazim Uddin / ২৭ ভিউ টাইম
আপডেট : রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১

বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। আর এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটি শোষিত, নিপীড়িত, নিরীহ, নির্যাতিত বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। বাংলাদেশে যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামই হঠাৎ করে হয়নি বা আকাশ থেকে পড়েনি। যে কোনো সংগ্রামের পিছনে তার অতীত ইতিহাস থাকে। আজ যেখানে বাংলাদেশ সেই ভূখণ্ডের অধিবাসীরাও হাজার বছর ধরে যে ধারাবাহিক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে নিজেদের পায়ের তলায় দাঁড়ানোর মতো একটি শক্ত মাটি অনুসন্ধান করেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর মত করে কেউ বলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি বাঙ্গালী জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি স্বাধীন দারিদ্রতা মুক্ত দুর্নীতি মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। ছাত্রজীবন থেকে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য।

৭ মার্চের ভাসণে জনসমুদ্র। ছবি- সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই কালজয়ী মহাপুরুষের এক তেজদীপ্ত ভাষণেই উদ্বুদ্ধ হয় গোটা জাতি। নিরীহ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে অস্ত্র হাতে নিলো পৃথিবীর অন্যতম একটি সামরিক শক্তি পাকিস্তানিদের (যাদের বন্ধু পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ) বিরুদ্ধে, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তের এবং ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় বাঙ্গালী জাতি বীরের জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকা হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আজকের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা প্রায়ই গর্ব করে বলেন- “আমরা বীরের জাতি, বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই”। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এই কথা বলেন তখন আমি নিজেকে একটা সহজ সরল প্রশ্ন করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মাত্র কয়েকজন সেনা সদস্য স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করে, বঙ্গবন্ধুর লাশ পরে রইলো ৩২ নম্বরের বাড়িতে, রাতারাতি বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার ষড়যন্ত্র হল। বাঙালি জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হল, কিন্তু চিৎকার করে কেউ কাঁদতে পারলো না। কেউ একটা আওয়াজ তুলল না? কোন বীর বজ্রকন্ঠে এই কথাটি বলল না- “আর যদি একটা গুলি চলে . . . .”। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই রুপসী বাংলার আদর্শ ও স্বপ্নের প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্ববাসীর কাছে ছিল একটি বিস্ময়। সেই মানুষটির জানাজা পড়ল মাত্র ১৬-১৭ জন।

আসতে পারলো না কোন বিশ্বনেতা! পরের দিন লন্ডনের বিখ্যাত দা ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকায় শিরোনামে এলো, “এই করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে ছিল তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না।”

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে তার নিজ হাতে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গঠন করেছিলেন সেনাবাহিনী। ছিল পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী, ছিল হাজার হাজার বীর মুক্তিসেনা যারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে হাসিমুখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া তার প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী। তার পরেও কেন নিশ্চুপ হয়ে গেল সবাই?

মাত্র কয়েকজন খুনি মীরজাফরদের হাতে জিম্মি হয়ে গেল বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এই হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর মাত্র ২টি ইউনিট সরাসরি নিয়েছে। বেঙ্গল ল্যান্সারস্ আর কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট-এর সৈনিকদের এই দুটি ইউনিটই ঢাকা’র ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। ১৪ই আগস্ট রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে। বিমানবন্দরে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক একত্রিত হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ প্রমুখ সেখানে জড়ো হন।

শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে কর্নেল ফারুক অফিসারদের নির্দেশ দেন বিমানবন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে। অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানান কর্নেল ফারুক। কর্নেল ফারুক-ই ছিলেন অপারেশনের দায়িত্বে। কি আশ্চর্য! ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বারের বাড়িতে ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দ সচিব ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অনেকেই। ১৫ই আগস্ট সকালবেলা বঙ্গবন্ধুর যাবার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, তার নিরাপত্তার কি কি বেবস্থা নেয়া হবে এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা চলছিল।

একটা মানুষও এই খবরটি পেলনা পুরনো বিমানবন্দরে মাঠে খোলা আকাশের নিচে প্রকাশে খুনিরা একত্রিত হয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বাধীনতার স্বপ্নস্রষ্টা ও রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা করা হয়েছে কিন্ত অনেকেই আক্রমণের কথা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বলার সুযোগ পায় নাই। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর প্রধানসহ অনেককেই টেলিফোন করে বলেছিলেন তাকে হত্যার জন্য তার বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমতের কারণে সেইদিন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের উনয়নের রোল মডেল। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহিন ঝুড়ি এখন এশিয়ান অর্থনীতির উদীয়মান বাঘ।

বাঙ্গালীরা বিস্মৃত প্রায় জাতি, অতি দ্রুত ইতিহাস ভুলে যায় তাই আমি খুব পিছনে যাব না। কাগজ কলমের উন্নয়নের কথা আমরা অনেক শুনেছি আমি সে কথাও বলবো না। আমি নিজের চোখে দেখা দৃশ্যমান কিছু উন্নয়নের কথা বলবো। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিন দেশের উন্নয়ন দেখছে তাই তার তেমন পার্থক্য দেখছেন না কিন্ত আমরা যারা প্রবাসে থাকি এক দুই বৎসর পর দেশে যাই আমাদের কাছে উন্নয়নের চিত্রটা খুব বড় করে চোখে পড়ে । আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর ২০০৯ সালে ঈদ করার জন্য রমজান মাসে জার্মানি থেকে দেশে গিয়াছিলাম। দেখলাম বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের বেড়াজালে সারা বাংলাদেশ। একবার বিদুৎ গেলে কখন আসবে কেউ বলতে পারতো না। মোমবাতি জ্বালিয়ে মসজিদে নামাজ আদায় করতে হত। বাংলাদেশের মানুষ তখন আন্দোলন করছিল অন্তত বাচ্চাদের লেখাপড়ার সময় বিদ্যুতের ব্যবস্হা করা হয়। আজ শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে সব নাগরিক বিদ্যুৎ পাবেন। আলোয় উদ্ভাসিত হবে সারা বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৫ সালে আমি জার্মানিতে আসি। তখন চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তিন চার সপ্তাহ লেগে যেত একটা চিঠি আসতে। মার চিঠি পড়ে মনে হতো পৃথিবীর সব ভালবাসা এই চিঠির মাঝেই লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে মা লিখতো বাবা তোর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করে। মার চিঠি পড়ে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসতো। আমাদের বাসায় টেলিফোন ছিল না শত ইচ্ছা থাকার পরও কথা বলা সম্ভব হত না। কিন্ত আজ যখন মন চায় ভিডিও কল দিয়ে মায়ের হাসি মুখটা দেখি।

ডিজিটাল বাংলাদেশে এই কথাটি কেউ কখনো বলেননি ২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বাংলাদেশের মানুষকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান। আজ বাংলাদেশের ৯৯% মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আর তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বের উন্নত একটি দেশ জার্মানি মাত্র ৮০% লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আত্মসম্মানের প্রতিক কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু, কর্নফুলী টানেল, মেট্টোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পারমানবিক কেন্দ্র সহ শত শত মেগাউন্নয়ন প্রকল্প আজ দৃশ্যমান।

সাম্প্রতিক কালে বিশ্বজুড়ে যে করোনা মহামারী ও সঙ্কট, সেখানেও করোনা জয়ের পথে বাংলাদেশ। করোনা মহামারী রুখতে যখন খোদ ইউরোপে করোনা প্রতিরোধ ভ্যাক্সিন সঙ্কট চলেছে তখন বাংলাদেশের জনগণ টিকা গ্রহণ করতে পারছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান বিশ্বে বিস্ময়কর। এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারত পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মত নেতা যদি থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা বীরের জাতি। বিশ্বের দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে গর্ব করে বলতে পারি আমরা বীর বাঙ্গালী।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বার্লিন আওয়ামী লীগ।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ